প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের কোনো সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছে আফগানিস্তানের তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকার।গত মঙ্গলবার কাতারের রাজধানী দোহায় জাতিসংঘের তত্বাবধানে ২দিন ব্যাপী ৩য় আন্তর্জাতিক দোহা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে অংশ নেয় তালেবানের নেতৃত্বাধীন সরকার।
জাতিসংঘের সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে ২৩ জুন দোহায় পৌঁছান আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাওলানা আমির খান মুত্তাকীর নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দল। সুযোগের সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে ২৪ জুন দোহায় নিজেদের মধ্যে বৈঠকে করেন তারা। তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনাধীন আফগানিস্তানের বর্তমান সমস্যা ও বাস্তব চিত্র সঠিকভাবে তুলে ধরতে সরকারের মুখপাত্র ও ডেপুটি তথ্যমন্ত্রী জাবিহুল্লাহ মুজাহিদকে প্রতিনিধি দলে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৩০ জুন কাতার যান জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ।
১ জুন জাতিসংঘের তত্বাবধানে শুরু হয় ২দিন ব্যাপী দোহা সম্মেলন। সম্মেলনে নারী শিক্ষা ও অধিকার, আফিম চাষ, মাদক পাচার ও চোরাচালান সহ আফগানিস্তানের সামাজিক সমস্যাগুলো আলোচ্য বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন মাওলানা জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ আফগান সরকারের প্রতিনিধি দলের প্রধান হিসেবে বক্তব্য রাখেন।
বক্তব্যে তিনি বলেন, পূর্বে আফগানিস্তানের উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে অনেক চিন্তা ও উদ্বেগ দেখা যেত। আফগানিস্তানের জনগণের প্রশ্ন আমেরিকা ও ন্যাটো জোটের বিরুদ্ধে তালেবানের জয়ের পর সেই চিন্তা ও উদ্বেগ এখন কোথায় গেলো।
আফগান জনগণ প্রশ্ন তুলছে, আফগানিস্তানের আর্থিক ও বাণিজ্য খাত থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হচ্ছে না কেনো? সরকারি-বেসরকারি খাতগুলোকে কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কেনো? এই খাতগুলোকে ধারাবাহিকভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে কেনো ?
মাওলানা জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, প্রায় অর্ধ শতাব্দী যাবত বিদেশী আগ্রাসনে যে আফগানদের ভয়াবহ যুদ্ধ ও নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছিলো তারা স্বাধীনতা অর্জন করেছে, যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছে, বিশ্বের সাথে ইতিবাচক সম্পৃক্ততার লক্ষ্যে নতুন ব্যবস্থাও গড়ে তুলেছে। তবুও কেনো নিষেধাজ্ঞা ও বিধিনিষেধের বেড়াজালে আফগানদের আটকে রাখা হচ্ছে? এসব কি ন্যায্য ও যথোপযুক্ত হতে পারে?
তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকারের মুখপাত্র আরো বলেন, আমরা জানি আমাদের কিছু নীতি অনেক দেশের জন্য সমস্যা মনে হতে পারে। মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নীতিগত পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু ভিন্ন মতের কারণে সংঘাত ও দূরত্ব না বাড়িয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও ইতিবাচক তৎপরতা অব্যাহত রাখার উপায় খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের অভিজ্ঞ কূটনীতিকদের।
মাওলানা জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, শক্তিশালী দেশগুলো নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আফগানিস্তানের ওপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত চাপ দেওয়ার ফলে আফগান জনগণের জনজীবনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। নীতিগত পার্থক্যের স্বাভাবিক বিষয়টিকে এমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়।
আফগান ডেপুটি তথ্যমন্ত্রী বলেন, একতরফা আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ, বহুমাত্রিক নিষেধাজ্ঞা ও চাপ সত্ত্বেও আমরা পপি বা আফিমের চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও চোরাচালান নিষিদ্ধ করেছি। আফগানিস্তানে আফিম চাষ সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্তি ঘটানোর বিষয়টি যদিও এখনো চ্যালেঞ্জের, তবুও আমরা প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে একে প্রায় শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনেছি।
আমাদের সরকারের এমন প্রচেষ্টা ও উদ্যোগগুলোর প্রশংসা ও স্বীকৃতি দিয়ে উচিৎ ছিল আফগানিস্তানের অর্থনীতিকে সচল করতে ব্যাংকিং খাত থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া ও জাতীয় রিজার্ভ মুক্ত করা। এসব না করে উলটো কিছু দেশ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অসহযোগিতার করে যাচ্ছে।
বুধবার দেশে ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে মাওলানা জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, জাতিসংঘের ৩য় দোহা সম্মেলনে ইমারাতে ইসলামিয়া সরকারের অংশগ্রহণ খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। আফগান সংশ্লিষ্ট প্রধানত ২টি বিষয় নিয়ে সম্মেলনে আলোচনা হয়েছে।
প্রথমত, সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলো জানতে চেয়েছে, কীভাবে উদ্বেগ কাটিয়ে উঠে বেসরকারি খাতের চলমান সমস্যা ও বাধাবিপত্তি দূর করা যেতে পারে। কীভাবে আফগানিস্তানের এই খাতকে তারা সহযোগিতা করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, তারা মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানের ব্যাপারে জানতে চেয়েছে, যা খুব ভালোভাবেই চলমান রেখেছে আমাদের সরকার। আমরা মাদক সংশ্লিষ্ট বাস্তবতা ও অভিযানের সাফল্য তাদের সামনে তুলে ধরেছি। আমরা জানিয়েছি, আফগান জনগণ যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, খুব ভালোভাবেই সেসবের মোকাবিলা করা হচ্ছে। বিশ্বের উচিত আফগানদের এই লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করা।
আফগান ডেপুটি তথ্যমন্ত্রী বলেন, সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন এসব বিষয়ে আমরা পৃথকভাবে আলোচনা ও তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছি। প্রথম দিন এতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সরকারের প্রতিনিধিগণ আফগানিস্তানের ব্যাপারে তাদের বক্তব্য ও অভিযোগ তুলে ধরেন। আমরাও তাদের বক্তব্য ও অভিযোগের বিপরীতে ইমারাত সরকারের অবস্থান ও বাস্তবতা তুলে ধরি। পাশাপাশি আমরা আফগান জনসাধারণের দাবী ও চাওয়া-পাওয়াও তুলে ধরেছি। আলহামদুলিল্লাহ, আমরা তা ভালোভাবেই তুলে ধরতে পেরেছি।
আমরা জানিয়েছি, আফগানিস্তান কোনো বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র নয়, আমাদের সরকারও বিচ্ছিন্নতা চায় না বরং বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে চায়। বিশ্বের সাথে সম্পৃক্ততা বজায় রাখতে চায়। আফগানিস্তানের সাথে যারা সম্পর্ক রক্ষা করছে তারা লাভবান হচ্ছে। ইতিবাচক সম্পর্ক স্থাপন করায় আমরা তাদের সাধুবাদ জানিয়েছি। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থাপনে যারা এখনো এগিয়ে আসেনি আমরা তাদের এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছি। অনুরোধ করেছি যোগাযোগ রক্ষার। আমরা তাদের বলেছি, আফগানিস্তান নিজেদের আবদ্ধ করে রাখা কোনো বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র নয়। আমাদের সরকার অনেক দেশের সাথেই ভালো সম্পর্ক স্থাপন করে তার প্রমাণ দিয়েছে। দেশে নিরাপত্তা ও বিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করেছে।
তালেবানের নেতৃত্বাধীন সরকারের মুখপাত্র আরো বলেন, আফগানিস্তানে যারা দূতাবাস খুলেছে তাদের প্রসঙ্গে আমরা বিস্তারিত জানিয়েছি। ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান বিভিন্ন দেশের সাথে এখন পর্যন্ত ভালো সম্পর্ক ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষত বাণিজ্য, ট্রানজিট ও বিনিয়োগ খাতে দেশগুলোর সাথে পারস্পরিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যা আফগানিস্তান ও সেসব দেশগুলোর জন্যও খুবই লাভজনক হচ্ছে।
এছাড়া দেশের উন্নয়ন ও উদ্ভুত চ্যালেঞ্জগুলোর ব্যাপারেও তাদের অবগত করা হয়েছে। ১৫ মিনিটের এক প্রেজেন্টেশনে দেশের উন্নয়ন ও উদ্ভুত চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো তুলে ধরেন আমাদের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি। খুটিনাটি দিক উল্লেখ করে তারা খুব চমৎকার ভাবে তা উপস্থাপন করেছেন। প্রেজেন্টেশনটি সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোকে মুগ্ধ করেছে। সম্ভাবনাময় বেসরকারি খাতকে ঘিরে ইমারাত সরকারের পরিকল্পনা ও কর্মযজ্ঞের প্রশংসায় তাদেরকে পঞ্চমুখ হতে দেখা গেছে।
২দিনের বৈঠকে আমরা আফগানিস্তানে মাদক সংশ্লিষ্ট বাস্তবতা, এর বিরুদ্ধে সরকারের কার্যক্রম ও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরি। এবিষয়েও ১৫ মিনিটের একটি প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করি, যেখানে ইমারাতে ইসলামিয়ার সরকারের মাদক বিরোধী অভিযান ও মাদকাসক্ত মুক্ত সমাজ বিনির্মানের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়। যা তাদের ভুল ভাঙাতে সাহায্য করে। প্রকৃত অবস্থা জানতে পেরে তারা অনুতপ্ত হোন। স্বীকার করে নেন যে, যোগাযোগ না থাকায় তারা ভুল বুঝাবুঝির শিকার হয়েছেন।
আমরা বিশ্বকে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছি যে, সবধরণের মানবিক ইস্যুকে রাজনৈতিক খাত থেকে পৃথক রাখতে হবে, যা সরাসরি আফগান জনসাধারণের দৈনিক জীবনধারণে প্রভাব ফেলে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে চাপ প্রয়োগের জন্য একে ব্যবহার করা যাবে না।
তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকার প্রতিনিধি দলের বক্তব্য ও প্রেজেন্টেশনের পর এতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো আফগানিস্তান ও এর বর্তমান সরকারের ব্যাপারে ইতিবাচক বার্তা দেন।
আমেরিকার বিশেষ প্রতিনিধি থমাস ওয়েস্ট এশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোকে কাবুলে যাওয়ার ও মানবিক সহায়তার লক্ষ্যে বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক তৎপরতা শুরুর আহবান জানান। দেশজুড়ে নিরাপত্তা প্রদান, দূর্নীতি বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করায় ইমারাতে ইসলামিয়া বা তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকারকে সফল সরকার বলে উল্লেখ করেন।
ব্রিটেনের বিশেষ প্রতিনিধি বলেন, আমরা ইমারাতে ইসলামিয়ার সরকারকে সহযোগিতা ও আফগান বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাথে যৌথভাবে কাজ করতে মুখিয়ে আছি।
রাশিয়ার বিশেষ প্রতিনিধি জমির কাবুলভ বলেন, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এই সরকার ও আফগান জনগণকে সহায়তার লক্ষ্যে প্রথমে তাদের বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রার রিজার্ভ মুক্ত করতে হবে।
চীনের বিশেষ প্রতিনিধি বলেন, পেশাদারিত্বের পরিচয় দিচ্ছে ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের উপস্থাপনাও ছিলো দারুণ।
কিরগিজস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশগুলোর উচিত আফগানিস্তানে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল পাঠানো। তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা বাদ দেওয়া।
ইরানের পক্ষ থেকে বলা হয়, মজবুত অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাই পারে আফগানিস্তানের সমস্যাগুলো সমাধান করতে। এই লক্ষ্যে দেশটির সরকারও অর্থনীতি বান্ধব পলিসি ও উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে।
পাকিস্তানের বিশেষ প্রতিনিধি আসিফ দুররানী বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা আফগানিস্তানের পাশে রয়েছি। তাদের অর্থনৈতিক তৎপরতাকে সমর্থন করি। এছাড়া আমরা আফগানদের শিক্ষাগত সুযোগ সুবিধা দিয়ে যেতে চাই।
২দিনের এই সম্মেলনে ইমারাতে ইসলামিয়ার সরকার প্রতিনিধিগণ কাতার, ইরান, উজবেকিস্তান, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার সরকার পর্যায়ে পৃথক পৃথক ও সম্মিলিত বৈঠক করেন।
