শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

যৌবনকাল : সফলতা অর্জনের মূল সময়

মুফতী মুহাম্মদ নোমান কাসেমী
পরিচালক : আল-মারকাযুল হানাফী বাংলাদেশ, ঢাকা


যৌবনের গুরুত্ব:
মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো তার যৌবনকাল। যৌবনকালকে জীবনের স্বর্ণ যুগ বলা যেতে পারে। এ যৌবনকাল যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন ঝুঁকিপূর্ণও। যৌবনকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, কিন্তু একটু কঠিন। সেই প্রকৃত সফল, যে তার যৌবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং তা কাজে লাগাতে পারে।
একজন যুবকের জন্য ভাল থাকাটা খুবই চ্যালেঞ্জিং হলেও তার খারাপ হওয়াটা অত্যন্ত সহজ। কারণ, এ সময়টাতে প্রতিটি যুবককে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে অসংখ্য অশুভশক্তি। কচু পাতার পানি যেমন টলমল করে, যেকোনো মুহূর্তে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তেমনি একজন যুবকও যে কোনো সময় পথভ্রষ্ঠ হয়ে যেতে পারে। জীবনের সব কিছু হয়ে যেতে পারে এলোমেলো। বর্তমানে সারা বিশ্বের যুবক মহল বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও সংকটে নিপতিত। তারা জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। তাই যুবসমাজকে সচেতন করা ও তাদেরকে অশুভশক্তির করাল গ্রাস থেকে রক্ষার চেষ্টা করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

যৌবনকালই হলো মানুষের জীবনের স্বর্ণ যুগ। উন্নত কর্ম সম্পাদন, ক্যারিয়ার গঠন ও নেক আমল করার মুখ্য সময়। এ সময়টিকে যে কাজে লাগাবে সে উন্নতি করতে পারবে। আর যে এ সময়টিকে হেলায়-খেলায় নষ্ট করবে সে জীবনে কোনো উন্নতি করতে পারবে না। কারণ, মানুষের যৌবনকাল হলো, দুটি দুর্বল পরিস্থিতি তথা বাল্যকাল ও বার্ধক্য কাল-এর মাঝে সামান্য কিছু সময়ের শক্তি। সুতরাং এ সময়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া, উপযুক্ত কাজে লাগানোর চেষ্টা করাই হলো বুদ্ধিমানের কাজ এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
اغتنم خمسا قبل خمس: شبابك قبل هرمك، وصحتك قبل سقمك، وغناك قبل فقرك، وفراغك قبل شغلك، وحياتك قبل موتك

“তোমরা পাঁচটি জিনিসকে অপর পাঁচটি জিনিসের পূর্বে গণিমত বা সুবর্ণ সুযোগ মনে কর। যৌবনকে কাজে লাগাও বার্ধক্য আসার পূর্বে, সুস্থতাকে কাজে লাগাও অসুস্থতার পূর্বে, সচ্ছলতাকে কাজে লাগাও অসচ্ছলতার পূর্বে, অবসরতাকে কাজে লাগাও ব্যস্ততার পূর্বে ও তোমার হায়াতকে কাজে লাগাও মৃত্যু আসার পূর্বে”। (মুসতাদরাকে হাকেম- হা: ৭৮৪৬)
ইমাম আহমদ রহ. বলেন, “আমি যৌবনকে এমন বস্তুর সাথে তুলনা করি, যা ক্ষণিকের জন্য আমার বগলের নীচে থাকে, তারপর আবার হারিয়ে যায়”।
যৌবনকাল হলো, ইবাদত বন্দেগী ও আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের সবচে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ কাল বেশি দিন স্থায়ী হয় না। যৌবন মানুষের জীবনে একজন আগন্তুক মেহমানের মত। জীবনে একবার আসে, আবার খুব দ্রুত হারিয়ে যায়। বুদ্ধিমান সে, যে তার যৌবনকে কাজে লাগায় এবং ভবিষ্যৎ জীবন তথা বার্ধক্য ও পরকালের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
الكيس من دان نفسه وعمل لما بعد الموت
‘প্রকৃত বুদ্ধিমান সে, যে নিজেকে চেনে ও পরকালে কাজে লাগে এমন আমল করে।’
যদি কেউ যৌবনকে কাজে না লাগায়, তবে তার আফসোসের অন্ত থাকে না। আফসোস তাকে শেষ করে দেয়। কবি যৌবন সম্পর্কে বলেন,
ضيف زارنا وقام عندنا قليلا .. .. سوّد الصحف بالذنوب وولى
“যৌবন হল, একজন মেহমান, যে আমাদের আঙ্গিনায় এসে কিছু সময় অবস্থান করল, তারপর গুনাহ দ্বারা আমলনামাকে কালো করে দিয়ে পালিয়ে গেল”।
যৌবন মানুষের জীবনে একবারই আসে। বার বার আসে না। যৌবন কাজে না লাগিয়ে অবহেলায় নষ্ট করলে, যেমন দুনিয়াতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমন আখিরাতে আল্লাহর দরবারেও তার জবাবদিহি করতে হয়। আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন মানুষের যৌবন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে বলবেন, তোমার যৌবনকে কোথায় ব্যয় করেছ এবং তা কিভাবে ক্ষয় করেছ? হাদিস শরীফে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

لا تزول قدما ابن آدم يوم القيامة من عند ربه، حتى يُسأل عن خمس: عن عمره فيم أفناه؟ وعن شبابه فيم أبلاه؟ وعن ماله من أين اكتسبه وفيم أنفقه؟ وماذا عمل فيما علم؟”
“কিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেয়া ছাড়া কোনো আদম সন্তান আল্লাহর সম্মুখ হতে পা সরাতে পারবে না। এক. তার জীবনকে কোন কাজে ব্যয় করেছে। দুই. যৌবনকে কোথায় ক্ষয় করেছে, তিন. সম্পদ কোথা থেকে অর্জন করেছে। চার. অর্জিত সম্পদ কোন পথে ব্যয় করছে। এবং পাঁচ. সে যা জেনেছে, তা কতটুকু আমল করেছে”। (তিরমিযী শরীফ, হা ২৪১৬)

আর যে ব্যক্তি নিজের যৌবনকে আল্লাহর ইবাদতে কাটায়, তার সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
وعدّ صلى الله عليه وسلم في السبعة الذين يظلهم الله في ظله يوم لا ظل إلا ظله: ্র شابا نشأ في عبادة الله”.

‘যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় ছায়াতলে যাদেরকে আশ্রয় দেবেন, তন্মধ্যে একজন হলো সে যুবক, যে তার যৌবনকে আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছে।’
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, আল্লাহ তা‘আলা যৌবনকালে বান্দাদেরকে বেশি জ্ঞান দান করেন। যাবতীয় কল্যাণ যৌবনেই লাভ করা সম্ভব।

হাফসা বিনতে সীরিন রহ. বলেন, “হে যুবক! তোমরা কাজ কর, যৌবনকালই হল কাজ করার সবচে উপযুক্ত সময়”। আহনাফ ইবনে কাইস রহ. বলেন, السودد مع السواد ‘নেতৃত্ব (চুল) কালো থাকা অবস্থায়’ অর্থাৎ, যদি কোনো ব্যক্তি যৌবন কালে নেতা না হতে পারে, সে বুড়ো কালেও নেতা হতে পারবে না।

ইসলাম প্রচারে যুবকদের ভূমিকা:

ইসলামের প্রথম যুগে যে সকল সাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঈমান আনেন, তাঁকে সাহায্য-সহযোগিতা করেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনিত হেদায়াতের আলোকবর্তিকা অনুসরণ করেন, তাঁরা সবাই ছিলেন যুবক। ইসলামের প্রথম যুগে যুবকদের দ্বারাই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর হাবীবের হাতকে শক্তিশালী করেছেন। যুবকদের দ্বারাই ইসলামের পতাকা সমুন্নত করেছেন। অনেক সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামী দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যুবকদের হাতেই ন্যস্ত করেছেন। যেমন, হযরত উসামা ইবনে যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু। হযরত আবু বকর রাযি. ও হযরত ওমর রাযি.-এর মত বড় বড় সাহাবীদের উপস্থিতিতে মাত্র আঠারো বছর বয়সে আল্লাহর রাসূল তাকে যুদ্ধের সেনাপতি নিযুক্ত করেন। হুনাইনের যুদ্ধে যাওয়ার সময় হাযরত উত্তাব ইবনে উসাইদ রাযি. কে মাত্র বিশ বছর বয়সে মক্কার গভর্নর নিয়োগ দেন। ইসলামের ইতিহাসে যুগযুগে ইসলামের ঝান্ডা বহন করা, ইসলামের পতাকাকে সমুন্নত রাখা এবং ইসলামের আলোকে দুনিয়ার আনাচে কানাচে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে যুবকদের ভূমিকা অপরিসীম। যার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে।

হযরত আবুল ইয়াকযান রহ. বলেন, হাজ্জাজ ইবনে ইউছুফ মুহাম্মদ বিন কাশেমকে সতের বছর বয়সে যুদ্ধের সেনাপতি বানিয়েছেন। তিনি পারসিকদের সাথে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছেন। তারপর তাকে সিন্ধু প্রদেশের সেনাপতি নির্বাচন করলে তিনি সিন্ধু ও ভারত উপ মহাদেশ জয় করেন।
আব্দুল্লাহ ইবন যিয়াদ তেইশ বছর বয়সে খুরাসানের গভর্নর নিযুক্ত হন। মু‘আয রাযি.কে ত্রিশ বছরেরও কম বয়সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়ামনের গবর্নর বানিয়ে পাঠান। নাহু ও আরবি ভাষার ইমাম ছিবওয়াই রহ. বত্রিশ বছরে মারা যান। ইবরাহীম নাখয়ী এর বয়স যখন মাত্র আঠারো, তখনো মানুষ তাঁর থেকে হাদিস গ্রহণ করেন,

যুবকরাই হলো উম্মতের কান্ডারি, মজবুত খুঁটি, চালিকা শক্তি ও প্রাণ, যুবকদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া কোনো দাওয়াত, কোনো আন্দোলন কখনোই সফল হতে পারে না। যুবকদের শক্তি ও তাদের আন্দোলনের উপর ভিত্তি করেই যে কোনো পদক্ষেপে সফলতা ও কামিয়াবী অর্জন করা যায়।
মোটকথা, যে সমাজ বা দেশে যুবসমাজের চরিত্র ভালো থাকবে, সে সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা ও স্বাভাবিক জীবনধারা ঠিক থাকবে। আর যে সমাজে যুবকদের চারিত্রিক ও নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেবে, সে সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা ও স্বাভাবিক জীবন কখনোই ঠিক থাকবে না। সে সমাজের পতন ও ধ্বংস অনিবার্য।

spot_imgspot_img

সর্বশেষ

spot_img
spot_img
spot_img
spot_img
spot_img